বুধবার, ২২ জানুয়ারী, ২০২৫

নামজারি বা মিউটেশন কি ? নামজারি কেন জরুরি ?

নামজারি করা কি জরুরী, নামজারী না করলে কি সমস্যা হয় ইত্যাদি কমন কয়েকটি প্রশ্ন প্রায়ই আসে। অনেকেই আবার চিরাচরিত ভাবে বলে থাকেন নামজারি বা মিউটেশন না করলেও কিছু হয় না। বিষয়টি কিন্তু সত্য নয়। আমরা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করছিঃ-

নামজারি বা মিউটেশন হচ্ছে জমিসংক্রান্ত বিষয়ে মালিকানা পরিবর্তন করা। কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কোন বৈধ পন্থায় ভূমি/জমির মালিকানা অর্জন করলে সরকারি রেকর্ড সংশোধন করে তার নামে রেকর্ড আপটুডেট (হালনাগাদ) করাকেই নামজারি বলা হয়। 

কোন ব্যক্তির নামজারি সম্পন্ন হলে তাকে একটি খতিয়ান দেয়া হয় যেখানে তার অর্জিত জমির একখানি সংক্ষিপ্ত হিসাব বিবরণী উল্লেখ থাকে। উক্ত হিসাব বিবরণী অর্থাৎ খতিয়ানে মালিকের নাম, কোন মৌজা, মৌজার নম্বর (জেএল নম্বর), জমির দাগ নম্বর, দাগে জমির পরিমাণ, একাধিক মালিক হলে তাদের নির্ধারিত হিস্যা ও প্রতি বছরের ধার্যকৃত খাজনা (ভূমি উন্নয়ন কর) ইত্যাদি লিপিবদ্ধ থাকে।
নামজারি বা মিউটেশন

নামজারি কেন জরুরি ?

১. নামজারি না থাকলে ভয়াবহ সমস্যা হতে পারে। আপনার নামজারি না থাকায় বিক্রেতা জমিটি পুনরায় প্রভাবশালী বা কারো কাছে বিক্রি করে দিতে পারেন অনায়াসে। ফলতঃ প্রভাবশালী বা কারো দ্বারা বেদখল হয়ে যেতে পারেন যেকোন মুহূর্তে।

২. সরকার যদি কোন জনস্বার্থ জনিত কারণে জমিটি অধিগ্রহণ করেন, সেক্ষেত্রে ক্ষতিপূরন যার নামে সর্বশেষ রেকর্ড বা নামজারি খতিয়ান, তার নামে আসবে বা চতুর বিক্রেতা ক্ষতিপূরণের টাকা তুলে নিতে পারেন। আপনি অহেতুক টাকা উদ্ধারের জন্য মামলা-মোকদ্দমায় জড়িয়ে পড়বেন এবং জীবন দূর্বিষহ হয়ে যাবে।

৩. হটাৎ যদি কোন কারণে বিক্রেতা কর্তৃক বা কোন ওয়ারীশী ঝামেলা থাকলে কারো দ্বারা বেদখল হোন, বা দাগের বা বড় দাগের একাধিক মালিক, আপনি অংশবিশেষ কিনেছেন এক্ষেত্রে নামজারি না থাকায় আপনি স্বীয় দখল প্রমাণ করতে সমস্যায় পড়বেন ইত্যাদি।

৪. কোন কারণে দখল প্রমাণের প্রয়োজন হলো, নামজারি না থাকায় দখল প্রমাণ করতে ঝামেলায় পড়তে পারেন।

৫. হেবার অন্যতম শর্ত হলো তাৎক্ষণিকভাবে দখল হস্তান্তর করা। হেবা নিয়ে কোন প্রশ্ন উঠলে দখল হস্তান্তর ও দখল প্রমাণ করতে না পারলে হেবা দলিলটি বাতিল হওয়ার সম্ভাবনা ১০০%। হেবা হওয়ার পর প্রথম কাজ হলো নামজারি করা।

৬. সম্পত্তি হস্তান্তর আইনের ৫৩(গ) ধারা অনুযায়ী সর্বশেষ রেকর্ড বা নামজারি খতিয়ানে মালিক বা মালিকের পূর্বসূরির নাম না থাকলে জমি বিক্রি করতে পারবেন না এবং বিক্রি করলে দলিল বাতিল হবে।
সম্পত্তি হস্তান্তর আইন, ১৮৮২ এর ধারা ৫৩-গ - "রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৫০-এর অধীনে প্রস্তুতকৃত সর্বশেষ খতিয়ানে কোন সম্পত্তি সম্পর্কে কোন ব্যক্তির নাম না থাকলে কোন সম্পত্তি বিক্রয় করা যাবে না এবং অন্যথায় যে কোন বিক্রয় বাতিল হবে। বিক্রেতা উত্তরাধিকার সূত্রে মালিক হলে খতিয়ানে তার বা তার পূর্বপুরুষের নাম থাকতে হবে, বিক্রেতা উত্তরাধিকার ব্যতীত অন্য কোন পন্থায় মালিক হলে খতিয়ানে তার নাম থাকতে হবে।
৭. দলিল মালিকানা বা স্বত্ব প্রমাণ করে কিন্তু দখল নয় অর্থাৎ দলিল মালিকের দখল প্রমাণ করে না। দখল প্রমাণিত হয় রেকর্ড বা নামজারি, খাজনা/ভূমি উন্নয়ন করের দাখিলা ইত্যাদি দ্বারা। স্মরণ রাখতে হবে যে, মালিকানা স্বত্ব ও দখল মিলিয়ে আপনি একটি জমির বাস্তবে মালিক। নইলে মঙ্গল গ্রহে কোন জমি কিনলেও তা আপনার কোন মঙ্গল করবে না।

৮. বর্তমানে ভূমি উন্নয়ন কর দেওয়া বাধ্যতামূলক এবং ৮.২৫ একর বা ২৫ বিঘা বা তার কম কৃষি জমি হলে ভূমি উন্নয়ন কর মওকুফ হলেও এখন প্রতি বছর ভূমি উন্নয়ন করের মওকুফ দাখিলা কাটা বাধ্যতামূলক। ক্রয়কৃত জমির নামজারি না থাকলে ভূমি উন্নয়ন কর দিতে পারবেন না ইত্যাদি।

৯. রেকর্ড, নামজারি, খাজনা / ভূমি উন্নয়ন করের দাখিলা ইত্যাদি দখলের পক্ষে প্রমাণ এবং এরা স্বত্বের দলিল না হলেও মালিকানার পক্ষে সাক্ষ্য বা এভিডেন্স।

১০. ২০ বছর আগেও বহু মানুষের অজানা ছিলো, বর্তমানে প্রায় সবাই জানেন যে, দলিল রেজিষ্ট্রেশনের দিনই সার্টিফাইড কপি বা জাবেদা নকলের আবেদন দেওয়া যায় এবং সচরাচর ১-৭ দিনের মধ্যে কপি পাওয়া যায় এবং কপি পাওয়ার সাথে সাথেই নামজারির আবেদন দিয়ে দিবেন ভূমি অফিসে। 

এই জাবেদা কপিটি হবে "মূল দলিলের অবিকল নকল"। মূল দলিল পাওয়ার পর আরেকটি সার্টিফাইড কপি তুলে নিবেন - এটি হবে "মূল দলিলের বালাম বইয়ে কৃত নকলের অবিকল নকল"। রেজিস্ট্রী অফিস পুড়ে গেলে, বালাম বই নষ্ট হয়ে গেলে ৫০ বছর পর মূল দলিল নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে বা মূল দলিল প্রমাণ করা কঠিন হয়ে যায় - এই সার্টিফাইড কপিদ্বয় মূল দলিলকে প্রমাণ করবে এবং সর্বদা মূল দলিলের প্রত্যয়ণ হিসাবে থেকে যাবে।

১১. নামজারি খতিয়ান না থাকলে ব্যাংক ঋণ, গৃহ ঋণ ইত্যাদি পাওয়া যায় না।

১২. নামজারি করা না থাকলে শরীকরা অগ্রক্রয়ের সুবিধা পেতে পারেন। নামজারি করে খতিয়ান পৃথক করে নিলে অগ্রক্রয়ের সম্ভাবনা সাধারন ভাবে থাকে না।

১৩. জরীপ ও নতুন চালু হওয়া বিডিএস জরীপে নামজারি অতীব গুরুত্বপূর্ণ।

১৪. সর্বশেষ রেকর্ড বা নামজারি খতিয়ানের পর নতুন নামজারির আবেদনে সর্বশেষ রেকর্ড বা সর্বশেষ নামজারি খতিয়ানের পূর্বে কি হয়েছিলো তা নিয়ে কোন প্রশ্ন করার এখতিয়ার ভূমি অফিস রাখে না।

১৫. আরেকটি ভুল দয়া করে কেউ করবেন না। মাঠপর্চা বা ডিপি খতিয়ান হয়েছে কিন্তু চূড়ান্ত প্রিন্ট রেকর্ড প্রকাশিত হয় নাই। এসময় সাবেক রেকর্ড দিয়ে জমি কিনলে অবশ্যই দলিলে মাঠপর্চা / ডিপি খতিয়ানের বিবরণ যথা নতুন দাগ, ডিপি খতিয়ানের বিবরণ দিবেন।
জমি কেনার পর অনেকে পরামর্শ দিবেন যে, নামজারি করবার দরকার নাই, প্রিন্ট খতিয়ান আসলে একবারে নামজারি করে নিবেন, এখন নামজারি করলেও তো আবার নামজারি করতে হবে, কি দরকার দুইবার টাকা খরচ করবার? অনুগ্রহপূর্বক এই পরামর্শে কর্নপাত করবেন না এবং এটা আবেগী ও ভুল পরামর্শ।

জমি কেনার সাথে সাথেই সার্টিফাইড কপি তুলে নামজারি করে নিবেন। এরপর প্রিন্ট খতিয়ান আসলে আবার নামজারি করে নিবেন। যেহেতু নতুন রেকর্ডে খতিয়ান ও দাগনং পরিবর্তিত হয়, তাই নামজারি করতেই হয়। লক্ষ লক্ষ টাকা দিয়ে জমি কিনলেন আর জমিটিকে সুরক্ষার জন্য, নিজেকে ও ভবিষ্যত বংশধরদের নিরাপদ করবার জন্য সামান্য কিছু টাকা দুইবার খরচ করতে পারবেন না - এটা যৌক্তিক নয়।
১৬. বিধানটি আগে থাকলেও নতুন ভূমি উন্নয়ন কর আইন, ২০২৩ এ ভূমি উন্নয়ন কর বকেয়া থাকলে জমি খাস করার বিধান করা হয়েছে এবং তা প্রয়োগও হবে মনে হয় এবং তিন বছর হয়ে গেলে বকেয়া ভূমি উন্নয়ন কর আদায় সরকারের জন্য তামাদি হয়ে যায় - এ বিধান অকার্যকর করা হয়েছে, এখন ভূমি উন্নয়ন কর বকেয়ার কোনো তামাদি নাই।

সুতরাং বুঝতেই পারছেন, নামজারি করা না থাকলে শুধু একাধিক বিক্রয়ের আশঙ্কাই বিদ্যামান থাকেনা, পরবর্তীতে আপনার অর্জিত সম্পত্তিতে দখলে থাকলেও পরবর্তীতে আপনার অবর্তমানে আপনার উত্তরাধিকারগণ উক্ত সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হবার আশঙ্কা থাকে।

তাই যাদের নামজারি করা নেই, তারা দ্রুত নামজারি করে ফেলুন ও নিয়মিত ভূমি উন্নয়ন কর প্রদান করুন ও নিজেকে ও বংশধরদের নিরাপদ রাখতে সহায়তা করুন এবং অন্যদের নামজারিতে উৎসাহী করুন।
নামজারি বা মিউটেশন কি ? নামজারি কেন জরুরি ? Dr. Delowar Jahan Imran 5 of 5
নামজারি করা কি জরুরী, নামজারী না করলে কি সমস্যা হয় ইত্যাদি কমন কয়েকটি প্রশ্ন প্রায়ই আসে। অনেকেই আবার চিরাচরিত ভাবে বলে থাকেন নামজারি বা মিউট...

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন