মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারী, ২০২৫

আপনার জমি বা সম্পত্তির দলিল হারিয়ে গেলে কি করবেন?

এটা আমাদের সবারই জানা যে জমি ​জমা বা সম্পত্তি ক্রয় বিক্রয়, বণ্টন এবং হস্তান্তর বিভিন্ন প্রকার দলিলের মাধ্যমে হয়ে থাকে। জমির দলিল আমাদের মূল্যবান কাগজগুলির মধ্যে একটি। জমির দলিলে ক্রেতা বিক্রেতার পূর্ণ পরিচয়, জমির একটি পূর্ণাঙ্গ পরিচিতি, সম্পাদন ও রেজিস্ট্রি হবার তারিখ এবং জমির মূল্য সহ আরও প্রয়োজনীয় তথ্য সন্নিবেশিত থাকে। তবে লিখিত এই দলিল কোন না কোন ভাবে হারিয়ে যেতে পারে।

জমির দলিল হারিয়ে গেলে করণীয় কাজগুলো সঠিকভাবে করলে হারিয়ে যাওয়া দলিল সহজে পাওয়া যাবে। অনেক সময় অসাবধানতা বা দূর্ঘটনাজনিত কারনে মূল্যবান দলিল বা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র হারিয়ে যায়। যেমনঃ- কোন দুর্ঘটনায় বা আগুনে পুড়ে যাওয়ার কারনে বা বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে মূল্যবান কাগজ বা দলিল নষ্ট হয়ে যেতে পারে। ঠিক এই সময় হারানো কাগজ ফিরে পাবার জন্য বা কাগজের নকল সংগ্রহ করার জন্য পুলিশের সাহায্য নেয়া যাবে।
জমি বা সম্পত্তির দলিল হারিয়ে গেলে কি করবেন
আমরা জানি কোন ব্যক্তির প্রয়োজনীয় কাগজপত্র হারিয়ে গেলে অতি দ্রুত সংশ্লিষ্ট থানায় গিয়ে জিডি করতে হয়। জিডি করার পর পুলিশ অভিযোগকারীকে জিডির একটা কপি এবং কপির সাথে একটি নম্বর প্রদান করবেন। সেটিকে আপনার সংরক্ষণ করে রাখতে হবে। এরপর পুলিশ হারিয়ে যাওয়া কাগজ খুঁজে বের করার চেষ্টা করবেন বা নকল বা নতুন কাগজপত্র বা দলিল প্রদান করার জন্য অনুমতি প্রদান করবেন।

সাধারণ ডায়েরি বা জিডি

দলিল হারিয়ে গেলে প্রথমে সংশ্লিষ্ট থানায় সাধারণ ডায়েরি বা জিডি করুন। এক্ষেত্রে সাধারণ ডায়েরি ফরমেট হতে পারে এমন-

বরাবর, অফিসার ইন চার্জ, ………… (থানার নাম ও ঠিকানা)

বিষয়ঃ সাধারণ ডায়েরি প্রসঙ্গে।

জনাব, বিনীত নিবেদন এই যে, আমি ………… (নাম/বয়স/পিতার নাম/পূর্ণ ঠিকানা) বিগত ………… ইং তারিখে …… (স্থানের নাম) হইতে বাস/রিক্সাযোগে ………(স্থানের নাম) যাবার সময় অনুমানিক ……… ঘটিকার সময় আমার সঙ্গে থাকা বিগত ……… ইং তারিখে রেজিঃকৃত ………… নং ……… দলিলটি, যার দাতার নাম ………… এবং গ্রহিতার নাম …………, হারিয়ে যায়। পরবর্তীতে বহু খোঁজাখুঁজির পর দলিলটি খুঁজে পাই নি। এমতাবস্থায় উপরোক্ত বিষয়টি সাধারণ ডায়েরিভুক্ত করার সুআজ্ঞা হয়।

বিনীত - (নাম/মোবাইল নম্বর)

এখানে আপনি চাইলে আপনার জমির তফসিল অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন। সাধারণ ডায়েরি করার পর একটি জিডি নম্বর দিবে। এটির এক কপি নিজের সংগ্রহে রাখুন। পুলিশ দলিলটি খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করবে। খুঁজে না পেলে মূল দলিলের সত্যায়িত নকল (Certified Copy) তুলতে হবে।
মনে রাখবেন, দলিল পুড়ে গেলে বা প্রাকৃতিক দূর্যোগের জন্য দলিল নষ্ট হয়ে গেলে থানায় জিডি করে রাখবেন।

আপনারা জমির দলিল দুটি উপায়ে উঠাতে পারবেন

প্রথম উপায় : প্রথমে নিচের তিনটি ধাপ অনূসরণ করুণ!

১) প্রথম ধাপ : 
  • প্রথমে জমির দাগ নাম্বার জানুন।
  • আপনি যে দাগটি জানেন সেটা কি দাগ তা নিশ্চিত হোন
  • আপনি যে দাগটি জানেন সেটা CS দাগ, না RS দাগ, না BS দাগ নিশ্চিত হোন
২) ধাপ ২:
  • দাগ নম্বর জেনে খতিয়ান নাম্বার জানুন।
  • কোথা থেকে জানবেন? -ইউনিয়ন ভূমি বা তফসিল অফিস হতে।
৩) ধাপ ৩: 
খতিয়ানে যদি নামজারি বা খারিজ করা থাকে তাহলে দেখুন কার নামে নামজারি করা। নামজারি বা জমাভাগের কেস বা নথি বের করে নিন। নামজারি বা খারিজের নথিতে দলিলের নাম্বার দেয়া থাকে সেখান থেকে দলিল নাম্বার নিয়ে নকল বা সার্টিফাইড কপির জন্য আবেদন করবেন।

কোথায় করবেন? জেলা রেকর্ড রুম অথবা সাব রেজিস্ট্রি অফিস। 
  • আপনার জমির দলিল যদি বর্তমান সাল থেকে ৫-৬ বছর আগের হয় তাহলে সাব রেজিস্টি অফিস হতে দলিলের নকল বা সার্টিফাইড কপি নিতে পারবেন।
  • আর দলিলটি যদি অনেক বছর আগের হয় তাহলে জেলা রেজিস্ট্রার অফিস এর জেলা রেকর্ড রুম হতে সংগ্রহ করতে হবে।
উপায় ২:-তিনটি ধাপ অনুসরণ করে দলিল নম্বর বা দলিল না পান তখন দলিল তল্লাশি বা সার্চ করতে হবে।
🔎 তল্লাশি বা সার্চ করতে যা যা লাগবে -
  • সম্ভাব্য সাল
  • দলিল দাতা ও গ্রহীতার নাম
  • দলিল দাতা ও গ্রহীতার বাবার নাম
  • দাগ নম্বর ও মৌজার নাম

আসুন বিষয়টি একটি দৃষ্টান্তের মাধ্যমে বুঝে নেই

ধরূণ আপনার বাবা আজিজ পৈত্রিকসূত্রে প্রাপ্ত ১৬ বিঘা জমি ভোগদখল করাকালে ২ বছর পূর্বে মারা যান। আপনার বাবা আজিজের মৃত্যুর পর এক পুত্র আব্দুল হক প্রামানিক ও এক কন্যা সেলিনা বেগম ওয়ারিশ থাকেন। আপনার বাবার ওয়ারিশ সূত্রে প্রাপ্ত ১৬ বিঘা সম্পত্তির সি.এস খতিয়ান, এসএ এবং আরএস খতিয়ান এবং আপনার দাদা (পিতামহ) এর নামের দলিলগুলোর ফটোকপি থাকলেও মূল কাগজপত্র খুঁজে পান নাই ।

মূল কপি কি প্রকারে সংগ্রহ করবেন সে বিষয়টা তুলে ধরা হলোঃ- আপনি আপনার বাবা আজিজের মৃত্যুকালে রেখে যাওয়া ঐ সম্পত্তির সি.এস খতিয়ান ও এসএ এবং আরএস খতিয়ানের জাবেদা নকল ভোলা কলেক্টরেট অফিস (জেলা প্রশাসকের কার্যালয়) রেকর্ড রুম হতে নির্দিষ্ট জাবেদা নকলের ফরমে আবেদন করে জাবেদা নকল তুলতে পারবেন। এছাড়া আপনার দাদা (পিতামহ) এর নামীয় দলিল ভোলা জেলা রেজিষ্টার অফিস হতে জাবেদা নকল তুলতে পারবেন। আপনি দলিলের ফটোকপি দেখে দলিলের নম্বর অনুসারে জাবেদা নকলের জন্য আবেদন করতে পারবেন।

দলিলের নকল (Certified Copy) প্রাপ্তির নিয়মাবলী

রেজিস্ট্রেশন আইন ১৯০৮ এর ৫৭(১) ধারা মোতাবেক, প্রয়োজনীয় ফিস পরিশোধ সাপেক্ষে, যে কোন ব্যক্তি ১ নং (স্থাবর সম্পত্তি সংক্রান্ত দলিলের) ও ২ নং (রেজিস্ট্রি করতে অস্বীকার করা দলিলের) রেজিস্টার বহি ও ১ নং রেজিস্টার বহি সম্পর্কিত সূচিবহি পরিদর্শন করতে পারে এবং উক্ত আইনের ৬২ ধারার বিধানাবলি সাপেক্ষে উক্ত দলিলের সার্টিফাইড কপি গ্রহন করতে পারে।

রেজিস্ট্রেশন আইন ১৯০৮ এর ৫৭(২) ধারা মোতাবেক, প্রয়োজনীয় ফিস পূর্বে পরিশোধ সাপেক্ষে, দলিল সম্পাদনকারী বা তার এজেন্ট এবং সম্পাদনকারীর মৃত্যুর পর যে কোন আবেদনকারী ৩ নং নিবন্ধিত উইলের রেজিস্টার ৩ নং লিপিবদ্ধ বিষয়ের (অর্থাৎ উইল বা অছিয়ত দলিলের নকল বা সার্টিফাইড কপি) এবং ৩ নং বহি সম্পর্কিত সূচিপত্রের নকল গ্রহন করতে পারে।

রেজিস্ট্রেশন আইন ১৯০৮ এর ৫৭(৩) ধারা মতে, প্রয়োজনীয় ফিস পূর্বে পরিশোধ সাপেক্ষে, দলিলের সম্পাদনকারী বা দাবীদার ব্যক্তি বা তার এজেন্ট অথবা প্রতিনিধি ৪ নং বহিতে লিপিবদ্ধ বিষয়ের নকল গ্রহন করতে পারে।

রেজিস্ট্রেশন আইন ১৯০৮ এর ৫৭(৪) ধারা মতে, ৩ নং ও ৪ নং বহিতে লিখিত বিষয়ের তল্লাশি, সাব-রেজিস্ট্রার এর মাধ্যমে করা যাবে।

কিভাবে দলিল তল্লাশ করবেন?

যদি মূল দলিল থাকে- রেজিস্ট্রি অফিসে দলিলের রেজিস্ট্রি কার্যক্রম শেষ হলে মূল দলিলের শেষ পৃষ্টার উল্টোদিকে “দলিলটি কত সালের, কত নম্বর বালাম বইয়ের, কত পৃষ্ঠা থেকে কত নম্বর পৃষ্ঠায় নকল করা হয়েছ, তা লিখে সাব-রেজিস্ট্রার কর্তৃক স্বাক্ষর করতে হয় । এভাবে খুব সহজে সহজেই রেজিস্ট্রি অফিসে থেকে দলিলের নকল উঠানো বা পাওয়া যায়।

মূল দলিল না থাকলে- রেজিস্ট্রি অফিসে দলিল রেজিস্ট্রি শেষ হলে দলিলের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি তথ্য নিয়ে সূচিবহি তৈরি করা হয়। একটি সূচিবহি তৈরি হয় দলিলে উল্লিখিত জমির দাতা/বিক্রেতা, গ্রহিতা/ক্রেতা বা অন্য কোন পক্ষের নাম দিয়ে, আর একটি তৈরি হয় জমির মৌজার নাম দিয়ে।

দলিলের নকল প্রাপ্তির আবেদনের নিয়মাবলি

রেজিস্ট্রেশন বিধিমালা ২০১৪ এর ১০৮ অনুচ্ছেদে সূচিবহি তল্লাশ ও দলিলের নকলের জন্য আবেদনের নিয়মাবলী লিপিবদ্ধ আছে।

এ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, যে সকল ক্ষেত্রে তল্লাশ ও পরিদর্শনের জন্য কোন ফিস পরিশোধযোগ্য নহে, সে সকল ক্ষেত্র ব্যতিত, সকল ক্ষেত্রে নকলের জন্য আবেদন দাখিল করিবার পূর্বে (৩৬ নং ফরম অনুযায়ী) তল্লাশ ও পরিদর্শনের জন্য আবেদন করিতে হইবে। এরপর ৩৭ নং ফরমে নকলের জন্য আবেদন করতে হবে।
আপনার জমি বা সম্পত্তির দলিল হারিয়ে গেলে কি করবেন? Dr. Delowar Jahan Imran 5 of 5
এটা আমাদের সবারই জানা যে জমি ​জমা বা সম্পত্তি ক্রয় বিক্রয়, বণ্টন এবং হস্তান্তর বিভিন্ন প্রকার দলিলের মাধ্যমে হয়ে থাকে। জমির দলিল আমাদের মূ...

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন